অপরিকল্পিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার বলি আরাল সাগর
জুমানা আক্তার তনুজা ও তাহসিন ইশরাক ঐশী
এক সময়কার বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম লেক আরাল সাগর, যা ছিল ঠিক আয়ারল্যান্ড এর আয়তনের সমান, আজ তা কোনোমতে টিকে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ মনুষ্য সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উদাহরণ হিসেবে। কীইবা এমন হয়েছিল যার কারণে আরাল সাগর শুকিয়ে গিয়েছিল? সেটি জানতে একটু ইতিহাস ঘুরে আসা যাক ।
আরাল সাগর এর উৎপত্তি সির দারিয়া এবং আমু দারিয়া নামক দুইটি নদী থেকে। সির দারিয়া তিয়ান শান পর্বতমালায় উৎপত্তি হয়ে, কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের উজানের দেশগুলির মধ্য দিয়ে এবং পরে উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান হয়ে আরাল সাগরে প্রবেশ করে। অপরদিকে পামির পর্বতমালা থেকে উৎপত্তি হয়ে আমু দরিয়া ভখশ ও পাঞ্জ নদীর সংযোগস্থলে আফগানিস্তান এবং তাজিকিস্তানের সীমান্তে গঠিত হয় এবং সেখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে আরালের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবাহিত হত। আরাল সাগরের নিকাশী অববাহিকা (drainage basin) উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরানের কিছু অংশে অন্তর্ভুক্ত ছিল।যুগ যুগ ধরে আরাল সাগর মধ্য এশিয়ার দেশসমূহের সাগর তীরবর্তী মানুষের প্রধান জীবিকা নির্বাহের একটি উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
কিন্তু এই সৌভাগ্যে বিপর্যয়ের শুরু ১৯৪৮ সাল থেকে, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এ স্তালিন ক্ষমতায় আসার পরপরই। ক্ষমতায় এসেই তিনি দুর্ভিক্ষ জর্জরিত দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেন। এরই অংশ হিসেবে তুলা উৎপাদন বাড়ানোর দিকে জোর দেয়া হয় যা কিনা ছিল দেশটির প্রধান রপ্তানি পণ্য । এই লক্ষ্যেই আরাল সাগরের পানির মূল উৎস আমু দারিয়া এবং সির দারিয়া নদী থেকে পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ কাজে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তখনও কেউই আন্দাজ করতে পারেনি এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব কত ভয়াবহ হতে পারে! বিপুল পরিমাণ পানি যা কিনা আগে আরাল সাগরে পতিত হত তা সেচ কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় লেকে আসা পানির পরিমাণ কমতে থাকে। যদিও আরাল সাগরের এই ক্রম সংকুচিত হওয়া মানুষের চোখে দৃশ্যমান হতে হতেই কেটে যায় আরও এক দশক। ততদিনে আরাল সাগর উত্তর থেকে দক্ষিণে ৪৩৫ কিমি এবং পশ্চিমে ২৯০ কিমি এর মত সংকুচিত হয়ে যায় [তথ্যসুত্র ১]।
১৯৬০-১৯৮০ সালের মধ্যে আরাল সাগরের প্রায় ১০০০ এরও বেশি জলাভূমি, নদী-বদ্বীপ মরুভুমিতে পরিণত হয়। আশির দশকে গ্রীষ্মকালে আরাল সাগর পুরপুরি শুকিয়ে যেত, শুধুমাত্র লবণাক্ততা বৃদ্ধির পরিমাণই ছিল চমকে দেবার মত। আগে প্রতি লিটারে যেখানে পানিতে লবণের পরিমাপ ছিল ১০ গ্রাম তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ গ্রামে! এই ভয়াবহতা কেবল পরিবেশের উপর দিয়েই যায়নি। পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা বাড়ার কারণে অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। এমনকি রক্ষা পায়নি স্থলজ প্রাণীরাও। লবণাক্ততার কারণে স্থলভাগের উদ্ভিদ গুলোও লবণাক্ত হয়ে যায় যা ছিল এই অঞ্চলের উট, গরু, ভেড়া এবং অন্যান্য পালিত পশুদের প্রধান খাদ্য। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে তাদের সলেনি নামক রোগ দেখা দেয় যার কারণে তীরবর্তী বহু মানুষ তাদের গৃহপালিত পশু হারিয়ে এই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়া শুরু করে [তথ্যসুত্র ২]।
এইখানেই শেষ নয়, পানির অভাবে ভূগর্ভস্থ পানি (Groundwater) উত্তোলন বেড়ে যায় এবং ফলস্বরূপ পানির স্তর প্রায় ১৫-২০ মিটার নেমে যায়। জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ সুপেয় পানির অভাবে ভুগতে থাকে। তবে লবণাক্ততাই একমাত্র সমস্যা ছিলনা, পানিতে এসে মিশেছিল এতদিন ধরে চলে আসা তুলা চাষে ব্যবহৃত সার এবং কীটনাশক।
আরাল সাগরের করুণ দশা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের উপরও বিরুপ প্রভাব সৃষ্টি করে । ধূলিঝড় হয়ে দাঁড়ায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ধূলির সাথে সাথে উড়ে আসতে থাকা লবণ সবার স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এইসব ধূলিঝড়ের সাথে লবণ উড়ে গিয়ে কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান এর কৃষি জমিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করা শুরু করে। ফলে দেশগুলোর কৃষি উৎপাদনশীলতা বহুলাংশে হ্রাস পায় ।পরবর্তীতে লবণের পরিমাণ এতই বেড়ে যায় যে তা উড়ে কিরগিজস্তানের পর্বতের শীর্ষে পৌঁছায়। যার ফলে পর্বতের উপরে থাকা হিমবাহ (Glacier) আরও দ্রুত গলতে শুরু করে; যা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের (Global Warming) প্রভাবকে ত্বরান্বিত করে [তথ্যসুত্র ৩]।
ছবিতে কালের পরিক্রমায় আরাল সাগরের সংকোচন [তথ্যসুত্র ৪]
১৯৮৭ সালের দিকে আরাল সাগরের পানি কমতে কমতে উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে দুই অংশে বিভক্ত হতে থাকে। পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে তাদের মধ্যকার দূরত্ব আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে যায়। ১৯৯১-১৯৯২ সালের মধ্যে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি হলেও পানি অপসারণ অব্যাহত রাখা হয় অর্থনৈতিক অবনতির আশঙ্কা থেকে।
প্রকৃতির প্রতি ধারাবাহিক এই আগ্রাসন চলতে চলতেই ২০০২ সালের দিকে আরাল সাগর পুরোপুরি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং এরা যথাক্রমে উত্তর এবং দক্ষিণ আরাল সাগর নামে পরিচিত হয়। উত্তর আরাল সাগর বর্তমান কাজাখস্তানে এবং দক্ষিণ আরাল সাগর উজবেকিস্তান অবস্থিত।
ছবিতে কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানে যথাক্রমে উত্তর এবং দক্ষিণ আরাল সাগর [তথ্যসুত্র ৫]
বর্তমানে আমরা উত্তর আরাল সাগরে পানি প্রবাহ দেখতে পেলেও দক্ষিণ আরাল সাগরকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই। দুইটি সাগরের ক্ষেত্রে একই পরিণতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও কাজাখস্তান সরকারের কিছু পদক্ষেপের কারণে বাঁচানো সম্ভব হয় উত্তর আরাল সাগরকে; তবে বিনিময়ে বলি দিতে হয় দক্ষিণ আরাল সাগরকে। ২০০০ সালে কাজাখস্তান সরকার ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর কাছে উত্তর আরাল সাগর এর সঙ্কোচন রোধে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রকল্পের বাস্তবায়নে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক দেশটিতে ৮৭ মিলিয়ন ডলার এর একটি বিনিয়োগ করে। উত্তর এবং দক্ষিণ আরাল সংযোগকারী ১২ কিমি দীর্ঘ একটি ডাইক (Dike) নির্মাণ করা হয় (কোকারল ড্যাম ) যার লক্ষ ছিল দক্ষিণ আরালের পানি প্রবাহ হ্রাস করে উত্তর আরালে প্রবাহ বৃদ্ধি করা। উল্লেখ্য, পরিকল্পনাটি হয়েছিল কাজাখস্তান সহ উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তানের সম্মতিতে । কোকারল ড্যাম নির্মাণের ফলাফল ছিল অপ্রত্যাশিত। ২০০৫ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হবার ৭ মাসের মধ্যে উত্তর আরাল সাগরের পানির উচ্চতা ৩.৩ মিটার বা ১০.৮ ফুট বৃদ্ধি পায়। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সাগরের লবণাক্ততা হ্রাস পেতে থাকে। শুধু তাই নয় ২০১০ সালের দিকে উত্তর সাগরটিতে আবারো জলজ প্রাণীর আনাগোনা শুরু হয়, পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের দেখা মিলতে শুরু করে। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ভাবে এই অঞ্চলে জীবনের স্পন্দন ফিরে আসেনি, এই প্রকল্পের অর্থনৈতিক প্রভাব আরালস্ক এবং তুস্তেবেক নামক তীরবর্তী দুইটি শহরে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। কোকারল ড্যাম এর কারণে উত্তর আরাল সাগরের পানি আরালস্ক শহরের ১৫ কিমি এর ভিতর চলে আসে; যা পূর্বের কয়েক দশকে প্রায় ৫০ কিমির চেয়েও বেশি দূরে চলে গিয়েছিলো। ফলে শহর দুইটি জেলেদের জীবিকা নির্বাহের অনুকূলে চলে আসে, সৃষ্টি হতে থাকে নতুন স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের। অঞ্চলটিতে ফিরে আসতে থাকে একসময় জীবিকার টানে ছেড়ে যাওয়া মানুষজন।
ড্যামটি নির্মাণের ফলে বছরে ২.৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি উত্তর আরালে প্রবাহিত করা সম্ভব হয়েছিল । ধারনা করা হয় ড্যামের দেয়াল আরও চার মিটার বাড়িয়ে উত্তর আরাল সাগরে অতিরিক্ত ১৫ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধরে রাখা সম্ভব [তথ্যসুত্র 6]। ফলে উত্তর আরাল সাগরটির আয়তনে আরও প্রসারণ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই পূর্ববর্তী পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ হিসেবে এটি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এ পেশ করা হয়েছে।
তবে দক্ষিণ আরাল সাগরকে উত্তর আরাল সাগরের মত বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এর কারণ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সুপরিকল্পনার অভাব। কিন্তু তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা না নিলে বাঁচানো সম্ভব হত না উত্তর আরাল সাগরকেও। আরাল সাগরের হারানো গৌরব পুরোপুরি ফিরে আসবে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর কেবল সময়ের হাতে ছেড়ে না দিয়ে প্রয়োজন ইতোমধ্যে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিক অনুসরণ, এক্ষেত্রে আরও প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমন্বিত প্রয়াস যা অনেকসময় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সম্ভবপর হয়ে উঠে না। কিন্তু আরাল সাগরের পুনরুজ্জীবন হলে তা হবে এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশের জন্যই আশীর্বাদস্বরূপ।
শুধুমাত্র পানির দুর্বল ব্যবস্থাপনা পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের জীবন ও জীবিকার কী পরিমাণ ক্ষতি ও ধ্বংযজ্ঞের কারণ হতে পারে তা আরাল সাগরের পরিণতি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কেননা আমরা বর্তমানে একটি ভয়াবহ জলবায়ু সংকটের (Climate Crisis) মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আর তাই মনুষ্যসৃষ্ট নিকট ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় - আরাল সাগরের ধ্বংস থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার এটিই সময়। কেননা পানির অব্যবস্থাপনাই পরিবেশ, জলবায়ু, অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটকে বহুগুণে ত্বরান্বিত করে।
লেখক পরিচিতিঃ
জুমানা আক্তার তনুজা ও তাহসিন ইশরাক ঐশী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ
ড. খন্দকার সাকিব ইশতিয়াককে লেখাটি পর্যালোচনা করার জন্য।
তথ্যসূত্র:
https://www.youtube.com/watch?v=xEIt4OojA3Y&t=850s
https://www.wri.org/blog/2008/05/disappearance-aral-sea?fbclid=IwAR1lRWLWw9rIbLzG04frcFUd4_Rba3n4s44xIpCAKab-W6XKM0Bf3ECFORY
https://youtu.be/_nB8cQKCW8o
Image Source: Reconsidering Russia
https://reconsideringrussia.org/2014/08/15/a-guide-to-the-stans-of-central-asia/aral-sea/
Image Source: Google maps
https://www.google.com/maps/place/North+Aral+Sea/@45.3935444,58.9468076,522152m/data=!3m1!1e3!4m5!3m4!1s0x418cc7884cf17107:0xe98ae3b4dd8d093a!8m2!3d46.4227904!4d60.7262401
https://www.bbc.com/future/article/20180719-how-kazakhstan-brought-the-aral-sea-back-to-life
https://en.wikipedia.org/wiki/Aral_Sea
https://youtu.be/5N-_69cWyKo (BBC News)
World's Water Crisis | FULL EPISODE | Netflix
https://earthobservatory.nasa.gov/world-of-change/AralSea (Nasa Earth Observatory)
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
তথ্যসুত্র ৭-১০ থেকে আহরিত তথ্যাবলী বিভিন্ন ভাবে লেখাতে ব্যবহৃত হয়েছে।